শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১   ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তরুণ কণ্ঠ|Torunkantho
২৯৬

দখলদার রক্ষার এ ভূমিকা কার স্বার্থে 

তরুণ কণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২১ জানুয়ারি ২০২৩  

বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সৃষ্টি, গড়ে ওঠা সভ্যতা এবং অধিবাসীদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে নদীর সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। দেড় হাজারের মতো নদীর অস্তিত্ব থাকলেও নির্বিচার দখল ও সীমাহীন দূষণে বেশির ভাগই এখন মৃতপ্রায়। নদ-নদী রক্ষায় সরকার ১০০ বছরের মহাপরিকল্পনা করেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠনের পাশাপাশি প্রণীত হয়েছে জাতীয় পানি আইন। উচ্চ আদালত বাংলাদেশের নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নদী রক্ষায় কমিশনকে অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, অভিভাবক সংস্থাটি দখলদারদের রক্ষায় রীতিমতো কোমর বেঁধে নেমেছে। 

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চার বছর সমীক্ষা চালিয়ে ৪৮টি নদী দখলের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছিল নদী রক্ষা কমিশন। কিন্তু গত ১৫ ডিসেম্বর কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দখলদার নিয়ে তৈরি করা সেই তালিকা প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এমনকি সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দখলদার স্থাপনার তালিকা দিয়ে পরে তা সরিয়ে নেওয়া হয়। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দখলদারদের নাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।


এ সিদ্ধান্তের পেছনে কমিশনের চেয়ারম্যানের যুক্তি হলো, উচ্চ আদালতের এক রায়ে সিএস রেকর্ডের ভিত্তিতে অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পে তাঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে পানি আইন ২০১৩-এর ভিত্তিতে। এ তালিকা প্রকাশ করলে আইনি ও প্রশাসনিক সমস্যা হতে পারে। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, সমীক্ষায় দখলদারদের নাম নেই, শুধু স্থাপনার নাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবেশ ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞ মুনির হোসেন চৌধুরী বলেছেন, প্রথমে দখলদারদের নাম দেওয়া হলেও কমিশনের চেয়ারম্যানের চাপে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পটি শুরুর সময় কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন মুজিবুর রহমান হাওলাদার। তিনি বলেছেন, সব আইন মেনে দখলদারদের তালিকা করা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে তালিকা বাদ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে দখলদারদের প্রশ্রয় দেওয়া। পরিবেশ আইনবিদেরাও বলছেন, ‘নদীদূষণ ও অবৈধ দখলদারি থেকে ৪৮ নদী রক্ষা’ প্রকল্পটিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার ব্যত্যয় হয়নি। এ প্রকল্পে দখলদার চিহ্নিত করতে শুধু পানি আইন নয়, বন্দর আইন ও ভূমি আইনের সহায়তা নেওয়া হয়। এ ছাড়া মহাকাশবিষয়ক গবেষণা সংস্থা স্পারসোর সহযোগিতা নিয়ে জিপিএসের ভিত্তিতে নদীর সীমানা নির্ধারণ করা হয়। সরেজমিনে পরিদর্শনও করেছেন প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।


এ প্রেক্ষাপটে সিএস খতিয়ানের দোহাই তুলে দখলদারদের তালিকা বাদ দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নদী কমিশন নিয়েছে, তা চূড়ান্ত অযৌক্তিক। কেননা, ১৯৪০ সালে করা সিএস খতিয়ানে চিহ্নিত সব নদ-নদীর অবস্থান এখন আর আগের জায়গায় নেই। পানি আইনে নদীর সীমানা ও তীরবর্তী ভূমিকে সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে। সিএস খতিয়ানের সঙ্গে পানি আইন সাংঘর্ষিকও নয়।

নদ-নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয় দখল ও দূষণের আশঙ্কাজনক চিত্র প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবশালী থেকে শুরু করে সরকারি সংস্থা—সবাই এ প্রক্রিয়ায় শামিল। উচ্চ আদালত নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে দখলদারদের কবল থেকে নদী মুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। 

একসময় দখলদারদের তালিকা তৈরি করে সারা দেশে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিল। সেটি এখন বন্ধ থাকায় দখলদারদের একপ্রকার পুনর্বাসনই করা হলো। আর এখন কমিশন অস্বচ্ছ উপায়ে দখলদারদের তালিকা প্রকাশ না করার যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে, তা স্মরণকালের মধ্যে নদ-নদীর ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত। নদী রক্ষা কমিশন কোনোভাবেই দখলদার রক্ষার কমিশনে পরিণত হতে পারে না। প্রশ্ন হলো, কার স্বার্থ রক্ষায় নেমেছে নদী কমিশন। অবৈধ দখলদারের নাম প্রকাশ না করলে কাদের নাম প্রকাশ করবে সংস্থাটি?

এই বিভাগের আরো খবর